লেটার-বক্স | ছোটগল্প
১৮৪, আনন্দ পালিত রোডের সরু গলিটাতে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা পোস্টম্যান আজ আবার ছাতা মাথায় সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে ঢুকেছে; নিঃসঙ্গ দুপুরের নিস্তব্ধতায় কিছুক্ষণের জন্য সেই উচ্চগ্রামের আওয়াজে ছেদ পড়েছে। অহর্ষি দোতলার ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে এক দৌড়ে নীচে এসে সদর দরজাটা খুলে বুকের মধ্যে ঊনিশটা কাঠবেড়ালি ছুটিয়ে জিজ্ঞেস করল,'চিঠি আছে গো কাকু?'
'না, ঋষি ভাই। আজও নেই।'
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাকহরকরা দুটো বাড়ির ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে গলির ও প্রান্তে মিলিয়ে গেল।অহর্ষি ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল,ভাবল আর কি আসবে না ওর চিঠি? হলদে বোগানভিলিয়া গাছের লাগোয়া দেওয়ালের গায়ে কাঠের লেটার-বক্সটা একবার দেখল; ছোট্ট একটি জং ধরা তালা ঝুলছে,কালো কালিতে ওর বাবার নাম লেখা-অ্যাডভোকেট সপ্তর্ষি সান্যাল। গত দুমাস ধরে স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিন এই সাইকেলের ঘন্টি শুনে ও নেমে আসে,ভাবে এই বুঝি চিঠি এল! পোস্টম্যান কাকু হাত দেখিয়ে 'নেই' বলে চলে যায়।
মুখ গোমড়া করে ও সোজা ছাদের ঘরে গিয়ে বসে রইল-বাড়ির সবাই এ সময় ঘুমোচ্ছে; রাস্তার ওপারে মসজিদ থেকে নামাজের সুর শোনা যাচ্ছে।অশীতিপর ঠাম্মার ঘর থেকে কীর্তনের আওয়াজ ভেসে আসছে। উনি রোজ এই সময়ে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন শোনেন।অহর্ষির ঐ করুণ সুরটা শুনলে মন খারাপ করে।ঠাম্মার কোলে মাথা এলিয়ে দেয় আর বৃদ্ধা নাতির চুলে বিলি কেটে দেন...মহাভারতের গল্প বলেন, আবার পুরনো বটুয়া থেকে মাঝে মাঝে আচার আর হজমি কেনার জন্যে পয়সাও দেন।অহর্ষি এন্টালি আকাডেমির অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে,অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য ওর বন্ধু কম। পাড়ায় তিনটে বাড়ি পরে ওর ছোটবেলার বন্ধু তসলীম থাকে। তসলীমের বাবা মেডিকেল কলেজের নামকরা ডাক্তার,লিয়াকত আলী। হিন্দু ব্রাহ্মণবাড়ির ছেলে ওদের বাড়ি মাঝে মধ্যে যেত;ঈদে সান্যাল বাড়িতে দাওয়াত আসত;এই চত্বরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনই সদ্ভাব ছিল। কিন্তু এক পারিবারিক বচসার জেরে ওর তসলীমদের বাড়ি যাওয়া এক বছর ধরে নিষিদ্ধ হয়েছে। অহর্ষি একা হয়ে গেছে। এখন নিজের জগতেই থাকে,ছবি আঁকে,বাঁশি বাজায় আর চিঠি লেখে...প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাড়ার এন্টালি পোস্ট-অফিসের ডাকবাক্সে গিয়ে ফেলে আসে।
মাস দুয়েক আগে একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একতলায় বাবার চেম্বার থেকে খবরের কাগজ নিয়ে ওল্টাতে ওল্টাতে একটি বিজ্ঞাপনে ওর চোখ আটকে যায়...
'মন খারাপ? বন্ধু নেই? মনের কথা বলে আমায় নীচের ঠিকানায় চিঠি লেখো...ঠিক দু'মাস পর আমি তোমার সাথে দেখা করব একটা দারুণ উপহার নিয়ে ! তার আগে তোমার ঠিকানায় চিঠি যাবে...
ইতি
তোমার বন্ধু মিতালিদি
সেইদিন থেকে অহর্ষি ওর রোজনামচা,মনের কথা একটা পুরোনো ডায়রির পাতায় লিখে লিখে সেই ঠিকানায় পাঠাতে লাগল। টিফিনের হাতখরচা বাবদ রোজ পাঁচটাকা দেন মা,সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে খাম আর ডাক টিকিট কিনে আনে।সকালে স্কুল যাওয়ার পথে দুই শালিক দেখা,পাশের বাড়ির বকুল দিদির পাগলামি,স্কুলের খিঁচিয়ে থাকা দিবাকর স্যারের চোখ রাঙানি, মা'র বকুনি আরো কত কি লেখে চিঠিতে !আর অপেক্ষা করতে থাকে কবে উত্তর আসে! লুকিয়ে লুকিয়ে মসজিদের মাজারে মাথা ঠেকিয়ে আসে,তাড়াতাড়ি যেন চিঠি আসে।ও একবার ভেবেছিল তসলীমকে চুপিসাড়ে কথাটা বলবে কিন্তু ঠিক করল চিঠির উত্তর এলে একেবারে সারপ্রাইজ দেবে। দেখতে দেখতে দেবীপক্ষ পড়ে গেল-- মা অহর্ষি কে নিয়ে নিউ মার্কেট গেলেন নতুন জামাকাপড় কিনতে।অন্যান্যবার এই সময়ে ওর মনে একটা উচ্ছ্বাস থাকে;কুমোরটুলিতে যায় ছোটকার সাথে ঠাকুর গড়া দেখতে,পাড়ায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় জলরঙে ছবি আঁকে। কিন্তু এবার অহর্ষি মনমরা-মুখ ব্যাজার করে স্কুলে যায় আর বাড়ি আসে,জানলার ধারে বসে ডাকহরকরার দুপুরের ঘন্টির অপেক্ষা করে।পোস্টম্যান এক দিন অন্তর ওদের গলিতে আসে আর ব্যালকনিতে চাতক পাখির মত বসে থাকা অহর্ষির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে চলে যায়। তবে কি মিতালিদি ওর চিঠিগুলো পাচ্ছে না? অহর্ষির মনে হল তক্ষুনি পোস্ট-অফিসে গিয়ে খোঁজ করে;ও হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে খালি পায়ে গলির ও প্রান্তে ছুট্টে গিয়ে ভাবল পোস্টম্যান কাকুকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে ওর চিঠিগুলো সেই খবরের কাগজের ঠিকানায় পৌঁচচ্ছে কিনা। কিন্তু ও কাউকে দেখতে পেল না।
বৃষ্টি ধোয়া ভোরে অহর্ষি বাবার সাথে তর্পণ দেখতে গেল; বাগবাজার ঘাটে যেন মানুষের মেলা--মাঝগঙ্গায় নেমে সবাই পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জল দিচ্ছে,ফুলমালা,মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে ওর মনের মধ্যে একটা অপূর্ব ভক্তিভাবের সঞ্চার হল।ওর ইচ্ছে করল গঙ্গায় নামতে,কিন্তু ইচ্ছা অবদমন করে ঘাটের এক কোণে অশ্বত্থগাছের নীচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।বাড়ি ফিরে লেটার-বক্সে উঁকি মারল অহর্ষি;একটা ইনল্যান্ড লেটার এসেছে! তবে কি তার উত্তর অবশেষে পৌঁছল ?ও তড়িঘড়ি লেটার-বক্স খুলে চিঠিটা হাতে নিল,বড় বড় হরফে ওর বাবার নাম লেখা,পেছনে সেন্ডারস্ নেম-এর জায়গায় লেখা
কুমকুম তরফদার। ওর মেজমাসি।অহর্ষি চুপচাপ চিঠিটা ওর মা'র হাতে দিয়ে দিল।উনি বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছেন অহর্ষির মন মেঘলা হয়ে আছে।আজ জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,
'হ্যাঁ রে ঋষি,অনেকদিন ধরেই দেখছি তোর মন খারাপ? কি হয়েছে রে? কোন বন্ধুর সাথে ঝগড়া করেছিস?'
'কই না তো,কিছু তো হয়নি।'
'শিগগির বলে ফেল,মাকে লুকিয়ে লাভ নেই।'
'বলছি তো কিছু হয়নি।'
'শোন মেজমাসি লিখেছে ওরা পুজোয় আসবে।আমরা একসাথে দার্জিলিং যাব ঘুরতে।'
'আমি যাবনা। তোমরা যেও'
'সে আবার কি? যাব না মানে? তোকে কার কাছে রেখে যাব?'
'আমি ঠাম্মীর কাছে থাকব।'
'হ্যাঁ,তাই করি। আশি বছরের বুড়ি তোমায় সামলাবে। দেখছিস না,ঠাম্মী আয়া ছাড়া বাথরুম যেতে পারছে না?'
পুজোর ছুটি পড়ে গেল কোর্টে,স্কুলে।সপ্তর্ষিবাবু এখন সারাদিন বাড়িতেই থাকেন।দিনের বেলা সাহিত্যচর্চা করেন আর সন্ধ্যে থেকে মক্কেলরা আসে।
একদিন সকালে অহর্ষিকে ডেকে বললেন,
'এই যে সক্রেটিস,কি এত চিন্তা করো সারাদিন? কোনো নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করলে?
শোনো,আমি তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি'
বলে গম্ভীর মুখে তিনি ধুসর হয়ে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের 'গল্পগুচ্ছ' বইটা ওর হাতে তুলে দিলেন।
-'এটা রোজ পড়া শুরু করো। বাঙালির ছেলে হয়ে যদি এখন থেকে একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ না পড়ো তাহলে আর....যে গল্পগুলো ভাল লাগবে লিখে রাখবে।পরে জিজ্ঞেস করব আমি'।
অহর্ষি খুব নিস্পৃহতার সাথে বইখানা নিয়ে ওর ঘরে চলে গেল। বাঁশিটা নিয়ে চোখ বুজে একটা বাউল সুর বাজাতে লাগল।
ষষ্ঠীর বোধন হল পাড়ার পুজো মন্ডপে,মেজমাসিরা গতকাল এসেছে।অহর্ষির মাসতুতো বোন পৃথা আজ সন্ধ্যায় ফাংশনে গান গাইবে সে জন্য জোর কদমে মহড়া চলছে বাড়িতে। সবাই আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত,শুধু ছেলেটার মনে সুখ নেই। পোস্ট-অফিসেও তালা পড়ে গেছে;পোস্টম্যান কাকু আবার কবে আসবে সেই ভাবনায় ও ডুবে রইল আর কেবল ঐ বিজ্ঞাপনের মিতালির কথা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ভাবতে লাগল!
বিজয়া দশমীতে বাড়ি ভর্তি আত্মীয়পরিজন,রান্নাঘর থেকে নতুন গুড় আর নারকেল বাটার গন্ধ ভেসে আসছে,মা-মেজমাসি নাড়ু পাকাচ্ছে, ঘুগনি তৈরি হচ্ছে। অহর্ষি দুহাতে কয়েকটা নাড়ু নিয়ে ঠাম্মার হাতে দিয়ে এল।ঠাম্মা এক গাল হেসে ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
'ঋষি দাদুভাই, তুমি এবার ছবি আঁকতে যাওনি?'
'না গো ঠাম্মী,এবার যাইনি। ইচ্ছে করল না।'
'তসলীমদের বাড়ি যাওয়া নিষেধ--ঐ জন্য বুঝি তোমার মন খারাপ?তা বেশ। আমার খারাপ মনটা একটু একটু বাঁশি বাজিয়ে ভাল করে দিও তো কালকে।'
অহর্ষি ঠাম্মীকে জড়িয়ে আদর করল,তারপর এক দৌড়ে বাঁশিটা ওর ঘর থেকে এনে বাজালো একটা কীর্তনের সুর।
এর দুদিন পর মেজমাসিদের সাথে অহর্ষিরা দার্জিলিং বেড়াতে গেল। ঠাম্মা ছোটকা আর আয়ার জিম্মায় রইলেন বাড়িতে। শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে চেপে পাহাড়ি রাস্তা উঠতে উঠতে অহর্ষির মনে হল ঠাম্মী এই দৃশ্য দেখতে পেল না;কষ্ট হল ওর।চারদিকে ঘন জঙ্গল,সর্পিল পাকদন্ডী পেরিয়ে কালো অ্যাম্বাসেডর এগিয়ে চলেছে,যত উপরে উঠছে তত নীচের শহরটা ছোট হয়ে আসছে। থোকা থোকা মেঘ উড়ছে,যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।অহর্ষির ইচ্ছে করল নেমে একটা ছবি আঁকে;অনেকদিন ও ছবি আঁকেনি।দার্জিলিং পৌঁছবার আগে ঘুমে ওরা জলখাবার খেতে দাঁড়াল। ওর বাবা, মা মেজমাসি সবে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়েছেন অহর্ষির চোখ পড়ল পাহাড়ি রাস্তার গায়ে লাল ডাকবাক্সে। ওর তক্ষুনি ইচ্ছে করল কলকাতায় ছুট্টে চলে যেতে,পাছে পোস্টম্যান কাকু এসে ফিরে যায়! কেউ তো লেটার-বক্স খুলেও দেখবে না,যদি মিতালিদি দেখা করতে আসে?
জীবনের প্রথম দার্জিলিং যাত্রাও ম্যাড়ম্যাড়ে ঠেকল অহর্ষির কাছে।ওর মন পড়ে রইল বাড়ির বাইরের সেই রঙ চটে যাওয়া চিঠি-বাক্সে।ওরা কালিম্পঙে একটা হোমস্টেতে রইল দুদিন---হেমন্ত আর শীতের সন্ধিক্ষণে চাবাগানগুলো সবুজ আভা ছড়িয়ে আছে,মন্যাস্টেরির অপূর্ব বৌদ্ধমন্ত্র প্রাণ-মন জুড়িয়ে দিচ্ছে আর হঠাৎ হঠাৎ আকাশ কালো করে এক পশলা বৃষ্টি এসে গভীর পাহাড়ি উপত্যকাটাকে আরো রহস্যময় করে তুলছে। একদিন বিকেলবেলা বাবার সাথে ঘুরতে ঘুরতে ম্যালের পেছনে ভিউ পয়েন্টে বসে অহর্ষি উদাস হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দার্জিলিং শহরের দিকে,সূর্য সবে অস্ত গেছে;আকাশে শেষ বিকেলের একটা রক্তিম আলোর আবেশ লেগে আছে,ইতি উতি মেঘগুলো ছেঁড়া তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে।অহর্ষির মনে হল এই মেঘের হাত ধরেই কি এখানে পৌঁছে যাবে ওর চিঠি?
পাঁচ দিনের মাথায় সকালবেলা ওরা বাড়ি ফিরে শোনে ঠাম্মী খুব অসুস্থ;ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বাথরুমে পড়ে গিয়ে ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে।ছোটকা লিয়াকত বাবুর সাহায্যে ওনাকে ভর্তি করতে পেরেছে। অহর্ষির বাবা-মা দুবেলা যাতায়াত করছেন হাসপাতালে,জ্ঞান আছে কিন্তু চিনতে পারছেন না কাউকে। ডাক্তাররা আশ্বাস দিতে পারলেন না।
দুদিনের মাথায় ঠাম্মী মারা গেলেন।অহর্ষিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি একদিনও।ঠাম্মীর নিথর শরীর বাড়িতে আনা হলে ও নীচে নামেনি,ঘর বন্ধ করে বসে ছিল। অনেক রাতে ওনার ঘরে গিয়ে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তনের ক্যাসেট-টা চালিয়ে চুপ করে বসেছিল।শ্রাদ্ধের দিন যখন সবাই ব্যস্ত পুজোর কাজে, ঠাম্মীর ঘরে গিয়ে ওনার বালিশে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল আর বাঁশিটা ছবির পাশে রেখে এসেছিল।সেদিন দুপুরেও পোস্টম্যান ঘন্টি বাজিয়ে চলে গিয়েছিল ওদের বাড়ি পেরিয়ে।
কালীপুজোয় সারা পাড়ায় আলোর রোশনাই,ছোটকা নিজে তুবড়ি বানায়। প্রতি বছর নিয়ম করে রোজ সেগুলো রোদে দেওয়া হয় এক মাস ধরে।এবার বাড়ি অন্ধকার;প্রদীপ জ্বলেনি,বাজি আসেনি।
অহর্ষি ছাদে গিয়ে দেখল আকাশে ফানুস উড়ছে, আলোর মালা গুলো ঠিকরে পড়ছে হাজার হাজার তারার মত। অন্যান্যবার শব্দবাজির তাণ্ডবে ঠাম্মীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হত;বেচারি কানে তুলো গুঁজে বসে থাকতেন সন্ধ্যে থেকে।এবার সেই অবকাশ নেই।পাড়ার কুকুরগুলো মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। সপ্তর্ষিবাবু চোঙাওলা গ্রামোফোনে পান্নালাল ভট্টাচার্যের গলায় 'সদানন্দময়ী কালী' শুনছেন চোখ বুজে।সারা বাড়ি জুড়ে এক অপার নৈঃশব্দ্য।
ঠাম্মীর প্রয়ানের সাথে অহর্ষির নিঃসঙ্গতা বাড়তে থাকল;একটা শামুকের মত নিজেকে খোলসের ভেতর ক্রমশ গোটাতে থাকল সে। স্কুলে যেতে চায় না,ঘর বন্ধ করে চুপচাপ বাঁশি বাজায়।মা ভাবলেন ছেলেকে কোথাও ঘোরাতে নিয়ে গেলে বুঝি মন ঠিক হবে!
'চলো কিছুদিন তোমার এই কোর্ট মক্কেল ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে আসো কোথাও।মা যাওয়ার পর থেকে দিনদিন ঋষি মনমরা হয়ে যাচ্ছে,আমার যে কিছুই ভাল লাগছে না। ওমন হাসিখুশি ছেলেটা... '
'আঃ কেঁদো না। দেখছি কি করা যায়। শুনছি দেশের অবস্থা ভাল নয়। ভাব গতিক দেখে যেতে হবে।'
হেমন্তর হিমেল আবহাওয়া কাটতেই ডিসেম্বর মাস...হাল্কা শীতের আমেজ শহরে।বড়দিনের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা সবে বসতে শুরু করেছে: ফ্রুট কেক,ক্রিসমাস ট্রি,তারার মালা চারদিকে। সপ্তর্ষিবাবু ঠিক করলেন অজন্তা-ইলোরা যাবেন ছেলের মন ভোলাতে। ওখান থেকে ফিরতি পথে পুণেতে ছোটবোনের বাড়ি হয়ে কলকাতা ফিরবেন। ট্রেনের টিকিট কাটা হল। ডিসেম্বরের আট তারিখ ওরা রওনা দেবে কলকাতা থেকে বোম্বে মেইলে।ছোটকাও ওদের সাথে যাবে এবার।সমস্ত গোছগাছ চলছে এদিকে,অহর্ষির মা বাড়িতে থাকা কিছু গয়নাগাটি ব্যাঙ্কের লকারে রেখে এসেছেন;এতদিন বাড়ি তালাবন্ধ থাকবে।ওর অঙ্কের মাস্টারমশাইকেও বলা হয়েছে দু'সপ্তাহ ছুটি।যাবার তিনদিন আগে সে অপেক্ষা করল ডাকহরকরার--পাছে এর মধ্যে চিঠি এসে ফিরে যায়! পোস্টম্যান এল না,অহর্ষি রাতে ডাকবাক্সের তালাটা খুলে রাখল।
ছয় তারিখ সন্ধ্যা থেকে দেশ শহর উত্তাল;জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে,মুসলমানরা মিছিল বের করেছে,অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের খবর এসেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে সেখানে নাকি রামমন্দির নির্মাণ হয়েছিল।দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেছে,এবার রক্তের বন্যা বইবে। অহর্ষিদের পাড়া স্তব্ধ! এক দল লোক মিছিল করতে করতে মশাল নিয়ে মসজিদের ওখানে গিয়ে জড়ো হয়েছে। মাইক নিয়ে চিৎকার করে হিন্দুদের বিষোদ্গার করছে ।অহর্ষি জানলার ধারে বসে এসব শুনছিল।ওর মা অবিন্যস্ত ঘরে ঢুকে বললেন,
'তুই এখানে কি করছিস ঋষি? শিগগির চল। সব জানলা বন্ধ কর।'
'ওরা চিৎকার করছে কেন?'
'জানিনা। দাঙ্গা লেগেছে। হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। তুই বাবার কাছে যা'
'তবে যে রবীন্দ্রনাথের 'মুসলমানীর গল্পে' কমলাকে মধুমোল্লার ডাকাতের হাত থেকে হবির খাঁ উদ্ধার করেছিলেন! উনিও তো মুসলিম ছিলেন।'
মা কোনো উত্তর করলেন না।
'আমরা আর তসলীমদের বাড়িতে ঈদের দাওয়াত খেতে যাব না?'
বলেই মাকে জড়িয়ে ধরল অহর্ষি।
অনেক রাত অবধি বোমাবাজি চলল,সেই সন্ধ্যায় কোন হিন্দু বাড়িতে শঙ্খ বাজলনা। মুসলমান মৌলবাদিরা মাঝরাতে কয়েকটা হিন্দু বাড়ি ভাঙচুর করল;পুলিশের গাড়ির সাইরেন আর বোমাবাজির আওয়াজে সবাই ঘরের দরজা এঁটে সিঁটিয়ে রইল।
রাতে অহর্ষির কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল,সারা রাত ও মাকে আঁকড়ে ধরে রইল।ভোরবেলা ওর বাবা যখন সদর দরজা খুললেন, দেওয়ালে চাপ চাপ রক্ত...গলিতে কাঁচের টুকরো,ওদের ফিয়েট গাড়িটা দুমড়ানো,আর অর্ধেক পুড়ে যাওয়া কাঠের ডাকবাক্সটা রাস্তার এক কোনে পড়ে আছে।
জানা গেল অহর্ষির সেই ঘন্টি বাজানো পোস্টম্যান কাকুকে গত রাতে দুষ্কৃতীরা খুন করে ফেলে গেছে সত্যনারায়ণ মন্দিরের ধারে...
সেদিন ভোরে মসজিদ থেকে আজানের মন কেমন করা সুর ভেসে আসছিল।
-কৌস্তভ
------------
ছবিঋণ: বেঙ্গল ওয়েব সলিউশান
#KaustavJoyGoswami
#LetterBox
#ShortStory
#ছোটগল্প
#কৌস্তভ