Thursday, August 27, 2020

দিনগুলি মোর || পন্ডিত যশরাজ


বাড়ীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিমণ্ডল ছিল আগেই হয়তো বলেছি।বাবার দুটো শখ ছিল----tie কেনা ও classical গানের cassette কেনা । সেই বিপুল সম্ভার থেকে রোজ রাতে নিয়ম করে চার-পাঁচটা cassette বাজত। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আলি আকবর খাঁ-র যুগলবনদী-live at Sanfrancisco;
উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি-র ঠুংরি 'প্রেম যোগন বনকে'/'আয়ে না বালম';Echoes of late golden voices(যেখানে ছিলেন আবদুল করিম খাঁ,পণ্ডিত ওমকারনাথ ঠাকুর এবং গাংগুবাঈ হাঙগল) এবং আরেকটি record যেটি আমার আজকের মূল প্রতিপাদ্য। আমি সেই সময় দশ ঠাট,এবং অল্প কিছু রাগরাগিনীর নাম জানতাম । এই cassette-টির একদিকে ছিল রাগ শুদ্ধ কল্যাণ,অপরদিকে ভীমপলশ্রী। দুটি নামই তখন আমার অজানা। যেহেতু তখনও বিলম্বিত একতাল শিখিনি মনে হত একজন গায়ক কিকরে একটি পদ নিয়ে এতক্ষণ এত বৈচিত্র্য ভরে গাইছেন। cassette-টিতে শিল্পীর যে ছবিটি ছিল সেখানে তাঁর চোখ বোজা,তানপুরাটা এলিয়ে আছে ডানদিকে। ওপরে লেখা :
The master from Mewati gharana
পণ্ডিত যশরাজ এমন মোহিনীমন্ত্র দিলেন যে নাওয়া খাওয়া ভুলবার উপক্রম হয়েছিল।এমন সুরেলা কণ্ঠস্বর! কী অনায়াসে তিন সপ্তকে সুর নিয়ে খেলছেন। ভীমপলশ্রীর দ্রুত বন্দিশটি আমার শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ।
"Ja Ja Rey Apne Mandirwa
Soon Pawegi Saas Nanadiya"
এরপর পণ্ডিত যশরাজ-এর প্রায় সমস্ত রেকর্ড চলে এল আমাদের বাড়িতে ।যোগ,দেশ,বাগেশ্বরী,নট ভৈরব,বৈরাগী,কোমল ঋষভ আশাবরী প্রভৃতি। ক্রমে ক্রমে যত গানের মধ্যে প্রবেশ করেছি,শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেছি,বূঝতে পেরেছি রাগ রাগিনীর ঐশ্বর্য। অনুভব করেছি পণ্ডিত যশরাজের মতো সঙ্গীতের ঈশ্বরকে।
ভীমপলশ্রীর সঙ্গে সেই আমার প্রথম প্রেম।তারপর রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা করতে গিয়ে যখন ভীমপলশ্রীর ছোঁয়া পেলাম, সে যে কী অর্নিবচনীয় আনন্দ হয়েছিল বলবার নয় ।
(সাগর সেন-এর কণ্ঠে 'প্রখর তপনতাপে')
সেই একই সুরের প্রয়োগ কিন্তু কি ভীষণভাবে রবীন্দ্রনাথের একান্ত আপন।
ভীমপলশ্রীর এই যাত্ৰা অব্যাহত রইল এবং তা এক হরষ- বিষাদের দোলাচলে আসমুদ্র হিমাচল পেরিয়ে আমার কাছে ফিরে এলো অপর্ণা সেন-এর ছবি 'পারমিতার একদিন'-এর শেষ দৃশ্যে । খুকু(সোহিনী সেনগুপ্ত )ছাদে বসে পায়রাদের মুড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং নেপথ্যে বেজে উঠছে বিপ্লবদা-র(বিপ্লব মণ্ডল) পাখোয়াজ-এর নিনাদ।
প্রবুদ্ধদা (প্রবুদ্ধ রাহা)গাইছেন 'বিপুল তরঙ্গ রে'। সবাই নিস্তব্ধ।।
(ক্রমশ)

দিনগুলি মোর || কচুরিপানা



ছোটবেলার রোব্বারগুলো ছিল অনাবিল আনন্দের। ভোরবেলা বাবার স্কুটারে চেপে পৌঁছে যেতাম কাছারিঘাট। ব্ৰহ্মপুত্ৰর পারে অবস্থিত এই জায়গাতেই সাপ্তাহিক হাট বসত।হরেক রকমের মাছ ও টাটকা সবজির পসরা নিয়ে বসত অহমিয়া বিক্রেতারা।বাবা যখন বোয়াল মাছ কিনতে ব্যস্ত আমি তখন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতাম প্রকাণ্ড নদের দিকে।মনে হত সুদূর থেকে ভেসে আসছে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠের বিখ্যাত অহমিয়া গান:
"মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র মহামিলনর তীর্থ
শত যুগ ধরি আহিসে প্রকাহি সমন্বয়র অর্থ"
এই নদের ঠিক মধ্যবর্তী অনচলে ছিল উমানন্দ দ্বীপ।বেশ একটা গা ছমছমে রহস্য ঘিরে থাকত জায়গাটিতে।ভোরবেলা সব ধার্মিক মানুষেরা মহেশ্বর কে আরাধনা করে ফিরতেন এবং নৌকাগুলি দুলুনি খেয়ে খেয়ে ঘাটের দিকে চলে আসত।সেই থেকেই নৌকা এবং মাঝি আমার মনের মণিকোঠায় একটা স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল।উত্তর পূর্বাঞ্চলের বর্ষাকালের দুটি বিপরীত রূপ।নয়নাভিরাম এবং ভয়ার্ত ।আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল 'বাণীকান্ত বালিকা বিদ্যালয়',আর তার ঠিক লাগোয়া একটা বিশাল কচুরিপানা ।বৃষ্টি হলে ভারী সুন্দর দেখতে লাগত সেই বিস্তৃত সবুজ কচুরিপানা ।পাতাগুলো থেকে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ত আর আমি সেই দৃশ্য বন্দী করতাম আমার আঁকার খাতায়।কচুরিপানায় একরকম হাল্কা বেগুনীরঙা ফুল হত।একবার হল কি,সেই বেগুনী ফুলের হাতছানি সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়লাম সেই ডোবায়।আমি তো ভয়ে চিৎকার করছি আর অদূরে দাঁড়িয়ে দরোয়ানের বাচ্চা মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে।খুব লজ্জা লেগেছিল । পরে অবশ্য সেই আমায় হাত বাড়িয়ে পানাপুকুর থেকে উদ্ধার করেছিল।এখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথের 'সমাপ্তি' গল্পের সেই দৃশ্য । অপূর্ব পাঁকে পড়ে যাওয়ার পরে মৃন্ময়ী ও ঠিক এভাবেই হেসেছিল।
বর্ষায় ফিরে আসি।কখনো দুদিনের টানা বৃষ্টিতে সারা গুয়াহাটি শহর জলমগ্ন।স্কুল কলেজ অফিস সব বন্ধ।সবাই গৃহবন্দী ।ওপরতলার মাসিমণি আর মা মিলে খিচুড়ি রান্না করত।সাথে পাঁপড়ভাজা।আমরা একান্নবর্তী পরিবারের মত একসাথেই খেতাম।বর্ষামুখর রাতগুলো কাটত বাবার কাছে গল্প শুনে।সবটাই তাৎক্ষণিক ও উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ।অনেকটা এরকম ।
"তারপর মাঝি খুব কষ্ট করে নদীতে বৈঠা বেয়ে যেতে লাগল।আর শরীর দিচ্ছে না।বাইরে নিশ্ছিদ্র অনধকার।ভীষণ মেঘ ডাকছে, বিদুৎ ঝিলিক দিচ্ছে ।মাঝির ছোট্ট ছেলেটা দেখল জালে একটা ইলিশ মাছ ধরা পড়েছে।তারপর মাঝি সেই মাছটাকে কেটে কড়াইতে ভাজা করল। ওরা দুজনে গরম ভাত দিয়ে ইলিশমাছ ভাজা খেল।"
আমার জানিনা কেন এই মাঝির জন্য খুব কষ্ট হত।মনে হত আমরা এই দুর্যোগের রাতে বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে আছি অথচ মাঝি কত কষ্ট করছে জীবিকা নির্বাহের জন্য ।
এখন ভাবি ছেলেবেলার গল্পের এই মাঝি-ই বুঝি বড়বেলায় গান হয়ে ফিরে এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শনে।
"ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি
শুনতে কি পাস্ ,দূরের থেকে 
পারের বাঁশি উঠছে বাজি।।"
(ক্রমশ)

কো থা য় পা ব তা রে || ফিরে দেখা২


শিল্পী রামকিঙ্করের জীবন অবলম্বনে 'দেখি নাই ফিরে' যখন ধারাবাহিক ভাবে 'দেশ'পত্রিকায় প্রকাশিত হত আমি গোগ্রাসে পড়ার চেষ্টা করতাম:ওই কিশোর বয়সে সবটা যে বুঝতাম তা নয়,কিন্তু এটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম কোন মাত্রায় একজন সৃষ্টিকর্তা আরেকজন অগ্রজ শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারেন; এমন একাগ্রচিত্তে তাঁর শিল্প,জীবন নিয়ে গভীর গবেষণা করে এরকম একটি পূর্ণাঙ্গ,নিটোল জীবনীমূলক উপন্যাস লিখে ফেলতে পারেন! এ তাবৎকালে শান্তিনিকেতনকে এমন কাছ থেকে আর কখনো কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই উপন্যাস অর্ধসমাপ্ত রেখেই লেখক প্রয়াত হন কিন্তু একটা নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেলেন আমার মত সাধারণ পাঠকের মনে...সমরেশ বসুর যেকটি লেখা(অমৃতকুম্ভের সন্ধানে,বি টি রোডের ধারে,কোথায় পাব তারে)পরবর্তীকালে পড়ার সুযোগ ঘটেছে বারবার মনে হয়েছে একজন নিরাসক্ত বাউলের গান শুনছি!

'অনেক পড়শি তো আছে,সময় বুঝে একবার নিজের ভেতরে যে পড়শির বসত,তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের ইচ্ছা।তারা তোমায় অনেক বলেছে,তুমি তাদের অনেক বলেছ।এবার নিজেকে নিজে একটু বলা কওয়া হোক....মন,চলো যাই খোপ ছেড়ে।দেহ থাকুক পড়ে।'

'কোথায় পাবো  তারে' পড়তে পড়তে আমিও সঙ্গী হয়েছি ভ্রমণের নেশায় মাতোয়ারা সেই পথিক পরাণের যে ইছামতীর বুকে ডিঙি নৌকায় ভাসতে ভাসতে এক অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করছে: সেই ছোট্ট হিন্দু ছেলেটি জলের ফোঁড় কেটে কেটে সাঁতার দিয়ে নদী পারাপার করছে আর অধর মাঝি,গাজি,নানী,সলিমা,কুসুম,চাচা,তাম্বুলরঞ্জিত চাচি,ঝিনিদের সাথে লেখক মিশে গিয়েছেন বর্ণিল মানুষের মেলায়। প্রকৃতি আর মানুষের নিবিড় সম্পর্কের এক সূক্ষ্ণ নক্সীকাঁথা বুনেছেন কালকূট তাঁর রূপক-অলংকারের অনবদ্য বিন্যাসে:বুড়িগঙ্গার ওপারে ইটভাটার চিমনি থেকে ওঠা ধোঁয়া,পাড়ের আড়ালে সবুজ পাংশু ধানক্ষেতে ডুবে যাওয়া উড়ন্ত প্রজাপতি,বনচড়াইয়ের দল,আকাশের ছায়াপড়া নীল ইছামতীর আরশি,গাঙশালিক-সমস্ত উপাদানগুলি কথকের সাথে এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র স্থাপন করে। মুরশেদের নাম করে গাজির বাঁ হাতের আঙ্গুলে প্যাচানো ঘুঙুর আর ডুবকির তালে তালে আমিও কন্ঠ মিলিয়ে গেয়েছি, 

'যার তরেতে মন ভুলেছে 
আমারে বলবে কে সে কোথা আছে!
তারে না দেখে যে হিয়া ফাটে 
সদা মন তাপে জ্বলে যাই,
মনের মানুষ কোথা পাই....'

'পারানি','মাধুকরী' এই শব্দগুলি আমি এই উপন্যাসেই প্রথম জেনেছি...একটা অপার রহস্যময় জগতের হদিশ পেয়েছিলাম পড়তে পড়তে,ঘোর লেগে যাওয়ার মত! পথিক রবীন্দ্রনাথ যেমন চলার নেশায় বুঁদ হয়ে পাগলপারা নদীর মত বয়ে চলেছেন আজীবন,সমরেশ বসুও একইভাবে গন্তব্যহীন হয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন রূপ থেকে অরূপের এই অন্বেষণে...এক মহাকালের যাত্রায়!

- কৌস্তভ 

#KothayPaboTaare
#Kalkut
#ALookingBack
#KaustavJoyGoswami

|| এ ক লা পা গ ল ||



'পাগল' শব্দের অর্থ যে জগতের তথাকথিত প্রথাগত হিসেব-নিকেশ গুলিয়ে ফেলেছে অথবা সেই নিয়মবিধির উর্দ্ধে যে জেহাদ ঘোষণা করেছে মুক্তকন্ঠে ....রবীন্দ্রনাথের 'পাগল' সীমার মাঝেও এক অসীমের স্পর্শ অনুভব করেছে;তাঁর রচনায়,গানে, 'পাগল' বারবার উঁকি মেরে যায়: বিশেষণ হয়ে 'খ্যাপা পবন','পাগলা হাওয়া','পাগল নদী'-তে আমরা তাকে পাই এক প্রাকৃতিক উন্মত্ততায়, যেন সৃষ্টি,স্থিতি,প্রলয়-র সাথে সে সমার্থক হয়ে দেখা দিচ্ছে। অপরদিকে মনস্তাত্ত্বিক আঙ্গিকে রক্তকরবী'র বিশু পাগল moral corrective হিসেবে আসে,তার একটা bohemianism আছে,আবার কতকটা Hamlet-এর মত 'There's a method in madness'...অন্ধকার যক্ষপুরীতে একমাত্র বিশুপাগল আর নন্দিনীর কথোপকথনের মধ্যেই আমরা দেখতে পাই একটুকরো 'খোলা আকাশ'....'নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে'-তে যেমন বাসনার বশবর্তী হয়ে মন পাগলের মত ভবঘুরে, 'যে তোরে পাগল বলে'/'পাগল যে তুই কন্ঠ ভরে'/'আঁধার রাতে একলা পাগল' ইত্যাদি গানে কোথাও একটা অন্য যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়: যেন এই আপাত পাগলামি-ই আসলে এক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে চলছে...এই পাগল আসলে 'আলোর ছেলে',যার সামনে পরমেশ্বর এক অনন্ত আঁধারের বলয় রচনা করে রেখেছেন...এই তমসা থেকে আলোর পথের যাত্রা খুব সহজ নয়;কবি তবু এই অসাধ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন,চারপাশের কলুষ থেকে তাঁর এই প্রিয় পাগলকে সন্তর্পণে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছেন এক নূতন আলোকে.প্রত্যয়ের সাথে বলছেন 'সাহস করে' সকলকে তাঁর পাগলামির কথা জানিয়ে দিতে;'সৃষ্টিছাড়া'-র অপবাদকে 'আমি কেহই না' বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে....কারণ আজ যে তাঁকে পাগল বলে প্রান্তিক করে রাখছে পরবর্তী সময়ে সেই হাতে মাল্যখানি নিয়ে তাঁর পিছু পিছু ধাওয়া করবে,এটাই irony of fate! রবীন্দ্রনাথের পাগল আসলে সেই ঝড়ের রাতের 'আঁধার ঘরের রাজা' যার জন্য শঙ্খধ্বনি হয়, যার আগমণ একরকম messiah বা পরিত্রাতার পদধ্বনির মত... 'ডাকঘর'-এর বালক অমলের মধ্যেও এই পাগলামি লক্ষ্য করা যায় তবে তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন:ওই বদ্ধ ঘর যদি যক্ষপুরীর সমার্থক হয় তার কল্পনার পৃথিবীতে সে এক আনন্দোন্মাদবিলাসী;ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে পাঁচমুড়া পাহাড়ের পাদদেশে লাল মাটির পথ ধরে যে রমণীদের পিছু নেয়....তার এই পাগলামির মধ্যেও এক নির্ভেজাল সারল্য! 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'পরশপাথর' কবিতায় যে পাগলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেটাই এই গোটা পরিসরের সারসংক্ষেপ করে দেয়:

'কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি 
মহাগাথা গান গাহি
সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর
কেহ যায়,কেহ আসে কেহ কাঁদে কেহ হাসে 
খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশপাথর'

কৌস্তভ

#KaustavJoyGoswami 
#EklaPagol
#Kobipokhho

পাতা ঝরার মরশুমে || ফিরে দেখা১

ফিরে দেখা বই | পাতা ঝরার মরশুমে 

আমাদের মত bibliophile-দের অনেক সময় বহুদিন আগে পড়া কোন বই আবার নতুন করে পড়তে ইচ্ছে হয়:এর একটি সদর্থক দিক এই ,যে তখনকার পাঠে যেসব আপাত কম গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হাওয়ায় ভেসে গিয়েছিল সেগুলোকে আরেকবার নতুন করে আবিষ্কার করা যায়; এতদিনের ধুলোর আস্তরনে ছোট ছোট চিত্রগুলোর ফিকে হয়ে যাওয়া রঙগুলো আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই হঠাৎ পাওয়া অখণ্ড অবসরে তেমন কিছু বই পড়ে ফেলার সুযোগ হচ্ছে,যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি' বা 'সঙ্গীতচিন্তা'র মত গভীর দর্শনসমৃদ্ধ বই যেমন আছে আবার ততটা ভারী নয়,এমন বই-ও আছে যা হয়ত আমার প্রাত্যহিক আটপৌরে জীবনের সাথে অনায়াসে সম্পর্ক স্থাপন করে কিন্তু খুব স্থায়ী রেশ রেখে যায় না....আসলে প্রতিটি মানুষই তো multilayered,অনেকগুলো সত্তা নিয়েই আমরা বাঁচি। আজ যে উপন্যাসটির কথা বলব সেটা আমি পড়েছিলাম ২০০৯ তে,কিন্তু তখন সত্যি, নথিভুক্ত করে রাখার মত কোনো বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করতে পারেনি,হয়তবা আমিই ততটা মনোসংযোগ করতে পারিনি। কিন্তু এই লেখকের একটা ক্রমশ বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা আমায় কিছুটা বাধ্য করেছিল বেশ কয়েকটি ছোট গল্প ও একটি উপন্যাস পড়ে ফেলতে....এই প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। উনি quintessentially এই প্রজন্মের লেখক,ওনার ভাষা নাগরিক জীবনের কথ্য ভাষা,যেখানে অনায়াসেই খিস্তি ঢুকে পড়ছে,খুব চেনা কিছু শহুরে jargon আসছে এবং সর্বোপরি এখনকার যুবসমাজের অস্থিরতা,তাদের অসহিষ্ণু দিকশূন্যহীনতা, সাধ আর সাধ্যের ব্যবধানের ফলে তৈরি হওয়া এক চূড়ান্ত প্রতিশোধস্পৃহার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। 'ঊনিশ কুড়ি' ম্যাগাজিন ওল্টাতে ওল্টাতে 'আমাদের এই শহরে' ধারাবাহিক গল্পটি পড়েছিলাম...বহু বছর আগে দূরদর্শনে দেখানো হত একটি ধারাবাহিক,'Neenv',কৈশোরের টানাপোড়েন নিয়ে,হস্টেল জীবনের বর্ণময়তা সেখানে প্রধান উপজীব্য ছিল ; তার সাথে খুব মিল পেয়েছিলাম।তারপর 'পাল্টা হাওয়া' যখন পড়েছি তার প্রেক্ষাপট,চরিত্র,তাদের রসায়নগুলো খুব চেনা লেগেছিল।রীপ,তিথি,পুষ্পল-দের সাথে আমিও সহমর্মী হয়েছি ওদের ব্যর্থতার, দেখেছিওদের প্রত্যেকের জীবনের পাল্টে যাওয়া গতিপথ। এই লেখককে পরপর যে পড়েছে তার হয়ত স্মরণজিৎ-এর কিছু imagery,শব্দের ব্যবহার,বাক্য গঠনের বুনোট পুনরাবৃত্তি মনে হবে: বাটানগর, ছোট হয়ে আসা গঙ্গা,জেটি,ওপারের ইটভাটার চিমনির ধোঁয়া,অশ্বত্থগাছ ইত্যাদি।কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে এত বছর পর আবার 'পাতা ঝরার মরশুমে' পড়ে মনে হল কিছু জায়গায় উনি খুব মৌলিক। একটা প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা-য় match fixing নিয়ে শুরু হয় উপন্যাসের আখ্যান এবং পরবর্তীকালে দিয়েগো,কবীর,ডুডু,রুদ্র,রুপাই,টাপুর-রা প্রবেশ করে গল্পে।বন্ধুত্ব, প্রণয়,প্রতিহিংসা,ও পারিবারিক সম্পর্কের চক্রব্যৃহর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এই চরিত্রগুলো কখনো philosophize-ও করে; একদিকে শীতকালের হাড় হিম করা কাঠিন্য ও পাশাপাশি তার কোমল,vulnerable রূপটি খুব স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাতন্ত্র্য মুন্সিয়ানায় এক প্রার্থিত প্রাকৃতিক আবহ রচনা করে গল্পে। এগারো বছর পর 'পাতা ঝরার মরশুমে' পড়তে পড়তে মনে হল ডিসেম্বরের কোন এক গোধূলিতে খুব দ্রুতগতিতে একটি ট্রেন নিষ্পলকে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল কিছু চেনা-আধোচনা যাত্রী নিয়ে...তারা অনেকেই হয়ত আবছাই থেকে গেছেন জীবনে।

"ঠান্ডাটা এবার সত্যিই বড় বেশি পড়েছে। ডুডু সাইকেল চালাতে চালাতেই এক হাতে জ্যাকেটের চেন গলা অবধি টেনে দিল।টমাস বাটা অ্যভিনিউয়ের ধারে ধারে যে গুলমোহর গাছ সেগুলো প্রায় সব পাতা ঝরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ও দেখল এখনো হালকা হাওয়ায় ছোট ছোট সবুজ পাতারা রঙিন কাগজের মত নেমে আসছে মাটিতে।পাতা ঝরার মরশুম এখন...পাতিলেবু রঙের একটা রোদ যাই যাই করছে আকাশে..."

#ThrowbackBooks
#PataJhawrarMorshumey
#SmaranjitChakraorty

প্রকাশক: আনন্দ

|| প র বা স ||



নিজগৃহে এমন শ্রাবণ-পরবাস মাঝে মাঝেই  মধ্যবৈশাখী দাবদাহের মত দুর্বিষহ হয়ে উঠছে;এই অনতিক্রম্য অবসাদেরও এক নির্লিপ্ততা এসেছে।বিছানার পাশে স্তূপীকৃত বই,ব্লুটুথ স্পিকার, দুটো ইয়ারফোন,প্যাঁচাওয়ালা কাঠের টুলে রাখা হারমোনিয়াম,দেওয়ালে এলিয়ে থাকা তানপুরা,'পথের পাঁচালী'র ছবি,মা'র ছবির পাশে ছোট ফুলদানিতে রাখা ফিকে রঙ্গন ফুল:এসব যেন এই চার মাসে একবারো জায়গা বদল করেনি!জানলার এপার থেকে সকালবেলা একটুকরো মেঘলা আকাশ দেখা যায়,সেখান দিয়ে সারাদিন উড়োজাহাজ যেত বন্ বন্ শব্দ করে,একেক সময় সেটা বিরক্তির কারণও হত... আকাশে এখন অস্বস্তিকর নৈশঃব্দ্য! পড়ন্ত মেঘলা  বিকেলের পাখিগুলোও যেন নিস্পৃহ,ওদেরও মন খারাপ;কতদিন মাছওলা,সবজিওলারা হাঁক দিয়ে দিয়ে যায় না আগের মত...'টাটকা রুই,পাবদা,ট্যাংরা আছে'! গৃহসহায়িকারা ভোরবেলা সাইকেল চালিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে ফ্ল্যাটগুলোয় ঘন্টি বাজাচ্ছে না কতদিন! খবরের কাগজের কাকু গত তিনমাস জিজ্ঞেস করেনি,'দাদা,এ মাসে কি দুটো 'দেশ'? বাড়ি থেকে বেরোলেই কেমন একটা নিঃশব্দ দ্বীপের নির্বাসিত বাসিন্দা মনে হয় নিজেকে---চেনা লোকগুলোর মুখ ঢাকা, সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময়টুকুর অবকাশও নেই! আতঙ্কিত,ত্রস্ত,সঙ্কুচিত অবয়বগুলো ছায়ার মত পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে...যেন এক মারণ স্পর্শের দুঃস্বপ্ন ঘিরে রয়েছে দিবারাত্রি...এই শ্রাবণে অ্যাসিড-বৃষ্টি শুরু হয়েছে...অ্যাপোক্যালিপ্স-এর সাইরেন বেজে চলেছে নিরন্তর---দেশ,কাল,সীমানা অতিক্রম করে,বিশ্বচরাচরে !

-কৌস্তভ

#KaustavJoyGoswami 
#Parabaash
#LockdownHijibiji

|| লেটার-বক্স ||

লেটার-বক্স | ছোটগল্প  

১৮৪, আনন্দ পালিত রোডের সরু গলিটাতে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা পোস্টম্যান আজ আবার ছাতা মাথায় সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে ঢুকেছে; নিঃসঙ্গ দুপুরের নিস্তব্ধতায় কিছুক্ষণের জন্য সেই উচ্চগ্রামের আওয়াজে ছেদ পড়েছে। অহর্ষি দোতলার ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে এক দৌড়ে নীচে এসে সদর দরজাটা খুলে বুকের মধ্যে ঊনিশটা কাঠবেড়ালি ছুটিয়ে জিজ্ঞেস করল,'চিঠি আছে গো কাকু?' 
'না, ঋষি ভাই। আজও নেই।'
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাকহরকরা দুটো বাড়ির ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে গলির ও প্রান্তে মিলিয়ে গেল।অহর্ষি ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল,ভাবল আর কি আসবে না ওর চিঠি? হলদে বোগানভিলিয়া গাছের লাগোয়া দেওয়ালের গায়ে কাঠের লেটার-বক্সটা একবার দেখল; ছোট্ট একটি জং ধরা তালা ঝুলছে,কালো কালিতে ওর বাবার নাম লেখা-অ্যাডভোকেট সপ্তর্ষি সান্যাল। গত দুমাস ধরে স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিন এই সাইকেলের ঘন্টি শুনে ও নেমে আসে,ভাবে এই বুঝি চিঠি এল! পোস্টম্যান কাকু হাত দেখিয়ে 'নেই' বলে চলে যায়।
মুখ গোমড়া করে ও সোজা ছাদের ঘরে গিয়ে বসে রইল-বাড়ির সবাই এ সময় ঘুমোচ্ছে; রাস্তার ওপারে মসজিদ থেকে নামাজের সুর শোনা যাচ্ছে।অশীতিপর ঠাম্মার ঘর থেকে কীর্তনের আওয়াজ ভেসে আসছে। উনি রোজ এই সময়ে টেপ রেকর্ডার চালিয়ে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন শোনেন।অহর্ষির ঐ করুণ সুরটা শুনলে মন খারাপ করে।ঠাম্মার কোলে মাথা এলিয়ে দেয় আর বৃদ্ধা নাতির চুলে বিলি কেটে দেন...মহাভারতের গল্প বলেন, আবার পুরনো বটুয়া থেকে মাঝে মাঝে আচার আর হজমি কেনার জন্যে পয়সাও দেন।অহর্ষি এন্টালি আকাডেমির অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে,অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য ওর বন্ধু কম। পাড়ায় তিনটে বাড়ি পরে ওর ছোটবেলার বন্ধু তসলীম থাকে। তসলীমের বাবা মেডিকেল কলেজের নামকরা ডাক্তার,লিয়াকত আলী। হিন্দু ব্রাহ্মণবাড়ির ছেলে ওদের বাড়ি মাঝে মধ্যে যেত;ঈদে সান্যাল বাড়িতে দাওয়াত আসত;এই চত্বরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনই সদ্ভাব ছিল। কিন্তু এক পারিবারিক বচসার জেরে ওর তসলীমদের বাড়ি যাওয়া এক বছর ধরে নিষিদ্ধ হয়েছে। অহর্ষি একা হয়ে গেছে। এখন নিজের জগতেই থাকে,ছবি আঁকে,বাঁশি বাজায় আর চিঠি লেখে...প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাড়ার এন্টালি পোস্ট-অফিসের ডাকবাক্সে গিয়ে ফেলে আসে।
মাস দুয়েক আগে একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একতলায় বাবার চেম্বার থেকে খবরের কাগজ নিয়ে ওল্টাতে ওল্টাতে একটি বিজ্ঞাপনে ওর চোখ আটকে যায়...

'মন খারাপ? বন্ধু নেই? মনের কথা বলে আমায় নীচের ঠিকানায় চিঠি লেখো...ঠিক দু'মাস পর আমি তোমার সাথে দেখা করব একটা দারুণ উপহার নিয়ে ! তার আগে তোমার ঠিকানায় চিঠি যাবে...

ইতি 
তোমার বন্ধু মিতালিদি

সেইদিন থেকে অহর্ষি ওর রোজনামচা,মনের কথা একটা পুরোনো ডায়রির পাতায় লিখে লিখে সেই ঠিকানায় পাঠাতে লাগল। টিফিনের হাতখরচা বাবদ রোজ পাঁচটাকা দেন মা,সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে খাম আর ডাক টিকিট কিনে আনে।সকালে স্কুল যাওয়ার পথে দুই শালিক দেখা,পাশের বাড়ির বকুল দিদির পাগলামি,স্কুলের খিঁচিয়ে থাকা দিবাকর স্যারের চোখ রাঙানি, মা'র বকুনি আরো কত কি লেখে চিঠিতে !আর অপেক্ষা করতে থাকে কবে উত্তর আসে! লুকিয়ে লুকিয়ে মসজিদের মাজারে মাথা ঠেকিয়ে আসে,তাড়াতাড়ি যেন চিঠি আসে।ও একবার ভেবেছিল তসলীমকে চুপিসাড়ে কথাটা বলবে কিন্তু ঠিক করল চিঠির উত্তর এলে একেবারে সারপ্রাইজ দেবে। দেখতে দেখতে দেবীপক্ষ পড়ে গেল-- মা অহর্ষি কে নিয়ে নিউ মার্কেট গেলেন নতুন জামাকাপড় কিনতে।অন্যান্যবার এই সময়ে ওর মনে একটা উচ্ছ্বাস থাকে;কুমোরটুলিতে যায় ছোটকার সাথে ঠাকুর গড়া দেখতে,পাড়ায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় জলরঙে ছবি আঁকে। কিন্তু এবার অহর্ষি মনমরা-মুখ ব্যাজার করে স্কুলে যায় আর বাড়ি আসে,জানলার ধারে বসে ডাকহরকরার দুপুরের ঘন্টির অপেক্ষা করে।পোস্টম্যান এক দিন অন্তর ওদের গলিতে আসে আর ব্যালকনিতে চাতক পাখির মত বসে থাকা অহর্ষির দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে চলে যায়। তবে কি মিতালিদি ওর চিঠিগুলো পাচ্ছে না? অহর্ষির মনে হল তক্ষুনি পোস্ট-অফিসে গিয়ে খোঁজ করে;ও হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে খালি পায়ে গলির ও প্রান্তে ছুট্টে গিয়ে ভাবল পোস্টম্যান কাকুকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে ওর চিঠিগুলো সেই খবরের কাগজের ঠিকানায় পৌঁচচ্ছে কিনা। কিন্তু ও কাউকে দেখতে পেল না।
বৃষ্টি ধোয়া ভোরে অহর্ষি বাবার সাথে তর্পণ দেখতে গেল; বাগবাজার ঘাটে যেন মানুষের মেলা--মাঝগঙ্গায় নেমে সবাই পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জল দিচ্ছে,ফুলমালা,মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে ওর মনের মধ্যে একটা অপূর্ব ভক্তিভাবের সঞ্চার হল।ওর ইচ্ছে করল গঙ্গায় নামতে,কিন্তু ইচ্ছা অবদমন করে ঘাটের এক কোণে অশ্বত্থগাছের নীচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।বাড়ি ফিরে লেটার-বক্সে উঁকি মারল অহর্ষি;একটা ইনল্যান্ড লেটার এসেছে! তবে কি তার উত্তর অবশেষে পৌঁছল ?ও তড়িঘড়ি লেটার-বক্স খুলে চিঠিটা হাতে নিল,বড় বড় হরফে ওর বাবার নাম লেখা,পেছনে সেন্ডারস্ নেম-এর জায়গায় লেখা
কুমকুম তরফদার। ওর মেজমাসি।অহর্ষি চুপচাপ চিঠিটা ওর মা'র হাতে দিয়ে দিল।উনি বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছেন অহর্ষির মন মেঘলা হয়ে আছে।আজ জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,
'হ্যাঁ রে ঋষি,অনেকদিন ধরেই দেখছি তোর মন খারাপ? কি হয়েছে রে? কোন বন্ধুর সাথে ঝগড়া করেছিস?' 

'কই না তো,কিছু তো হয়নি।' 

'শিগগির বলে ফেল,মাকে লুকিয়ে লাভ নেই।'

'বলছি তো কিছু হয়নি।' 

'শোন মেজমাসি লিখেছে ওরা পুজোয় আসবে।আমরা একসাথে দার্জিলিং যাব ঘুরতে।' 

'আমি যাবনা। তোমরা যেও'

'সে আবার কি? যাব না মানে? তোকে কার কাছে রেখে যাব?'

'আমি ঠাম্মীর কাছে থাকব।'

'হ্যাঁ,তাই করি। আশি বছরের বুড়ি তোমায় সামলাবে। দেখছিস না,ঠাম্মী আয়া ছাড়া বাথরুম যেতে পারছে না?'

পুজোর ছুটি পড়ে গেল কোর্টে,স্কুলে।সপ্তর্ষিবাবু এখন সারাদিন বাড়িতেই থাকেন।দিনের বেলা সাহিত্যচর্চা করেন আর সন্ধ্যে থেকে মক্কেলরা আসে।

একদিন সকালে অহর্ষিকে ডেকে বললেন,
'এই যে সক্রেটিস,কি এত চিন্তা করো সারাদিন? কোনো নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করলে?
শোনো,আমি তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি'
বলে গম্ভীর মুখে তিনি ধুসর হয়ে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের 'গল্পগুচ্ছ' বইটা ওর হাতে তুলে দিলেন।

-'এটা রোজ পড়া শুরু করো। বাঙালির ছেলে হয়ে যদি এখন থেকে একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ না পড়ো তাহলে আর....যে গল্পগুলো ভাল লাগবে লিখে রাখবে।পরে জিজ্ঞেস করব আমি'।

অহর্ষি খুব নিস্পৃহতার সাথে বইখানা নিয়ে ওর ঘরে চলে গেল। বাঁশিটা নিয়ে চোখ বুজে একটা বাউল সুর বাজাতে লাগল।

ষষ্ঠীর বোধন হল পাড়ার পুজো মন্ডপে,মেজমাসিরা গতকাল এসেছে।অহর্ষির মাসতুতো বোন পৃথা আজ সন্ধ্যায় ফাংশনে গান গাইবে সে জন্য জোর কদমে মহড়া চলছে বাড়িতে। সবাই আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত,শুধু ছেলেটার মনে সুখ নেই। পোস্ট-অফিসেও তালা পড়ে গেছে;পোস্টম্যান কাকু আবার কবে আসবে সেই ভাবনায় ও ডুবে রইল আর কেবল ঐ বিজ্ঞাপনের মিতালির কথা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ভাবতে লাগল! 
বিজয়া দশমীতে বাড়ি ভর্তি আত্মীয়পরিজন,রান্নাঘর থেকে নতুন গুড় আর নারকেল বাটার গন্ধ ভেসে আসছে,মা-মেজমাসি নাড়ু পাকাচ্ছে, ঘুগনি তৈরি হচ্ছে। অহর্ষি দুহাতে কয়েকটা নাড়ু নিয়ে ঠাম্মার হাতে দিয়ে এল।ঠাম্মা এক গাল হেসে ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

'ঋষি দাদুভাই, তুমি এবার ছবি আঁকতে যাওনি?'

'না গো ঠাম্মী,এবার যাইনি। ইচ্ছে করল না।'

'তসলীমদের বাড়ি যাওয়া নিষেধ--ঐ জন্য বুঝি তোমার মন খারাপ?তা বেশ। আমার খারাপ মনটা একটু একটু বাঁশি বাজিয়ে ভাল করে দিও তো কালকে।'

অহর্ষি ঠাম্মীকে জড়িয়ে আদর করল,তারপর এক দৌড়ে বাঁশিটা ওর ঘর থেকে এনে বাজালো একটা কীর্তনের সুর।
এর দুদিন পর মেজমাসিদের সাথে অহর্ষিরা দার্জিলিং বেড়াতে গেল। ঠাম্মা ছোটকা আর আয়ার জিম্মায় রইলেন বাড়িতে। শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে চেপে পাহাড়ি রাস্তা উঠতে উঠতে অহর্ষির মনে হল ঠাম্মী এই দৃশ্য দেখতে পেল না;কষ্ট হল ওর।চারদিকে ঘন জঙ্গল,সর্পিল পাকদন্ডী পেরিয়ে কালো অ্যাম্বাসেডর এগিয়ে চলেছে,যত উপরে উঠছে তত নীচের শহরটা ছোট হয়ে আসছে। থোকা থোকা মেঘ উড়ছে,যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।অহর্ষির ইচ্ছে করল নেমে একটা ছবি আঁকে;অনেকদিন ও ছবি আঁকেনি।দার্জিলিং পৌঁছবার আগে ঘুমে ওরা জলখাবার খেতে দাঁড়াল। ওর বাবা, মা মেজমাসি সবে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়েছেন অহর্ষির চোখ পড়ল পাহাড়ি রাস্তার গায়ে লাল ডাকবাক্সে। ওর তক্ষুনি ইচ্ছে করল কলকাতায় ছুট্টে চলে যেতে,পাছে পোস্টম্যান কাকু এসে ফিরে যায়! কেউ তো লেটার-বক্স খুলেও দেখবে না,যদি মিতালিদি দেখা করতে আসে? 

জীবনের প্রথম দার্জিলিং যাত্রাও ম্যাড়ম্যাড়ে ঠেকল অহর্ষির কাছে।ওর মন পড়ে রইল বাড়ির বাইরের সেই রঙ চটে যাওয়া চিঠি-বাক্সে।ওরা কালিম্পঙে একটা হোমস্টেতে রইল দুদিন---হেমন্ত আর শীতের সন্ধিক্ষণে চাবাগানগুলো সবুজ আভা ছড়িয়ে আছে,মন্যাস্টেরির অপূর্ব বৌদ্ধমন্ত্র প্রাণ-মন জুড়িয়ে দিচ্ছে আর হঠাৎ হঠাৎ আকাশ কালো করে এক পশলা বৃষ্টি এসে গভীর পাহাড়ি উপত্যকাটাকে আরো রহস্যময় করে তুলছে। একদিন বিকেলবেলা বাবার সাথে ঘুরতে ঘুরতে ম্যালের পেছনে ভিউ পয়েন্টে বসে অহর্ষি উদাস হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দার্জিলিং শহরের দিকে,সূর্য সবে অস্ত গেছে;আকাশে শেষ বিকেলের একটা রক্তিম আলোর আবেশ লেগে আছে,ইতি উতি মেঘগুলো ছেঁড়া তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে।অহর্ষির মনে হল এই মেঘের হাত ধরেই কি এখানে পৌঁছে যাবে ওর চিঠি?

পাঁচ দিনের মাথায় সকালবেলা ওরা বাড়ি ফিরে শোনে ঠাম্মী খুব অসুস্থ;ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বাথরুমে পড়ে গিয়ে ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে।ছোটকা লিয়াকত বাবুর সাহায্যে ওনাকে ভর্তি করতে পেরেছে। অহর্ষির বাবা-মা দুবেলা যাতায়াত করছেন হাসপাতালে,জ্ঞান আছে কিন্তু চিনতে পারছেন না কাউকে। ডাক্তাররা আশ্বাস দিতে পারলেন না। 
দুদিনের মাথায় ঠাম্মী মারা গেলেন।অহর্ষিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি একদিনও।ঠাম্মীর নিথর শরীর বাড়িতে আনা হলে ও নীচে নামেনি,ঘর বন্ধ করে বসে ছিল। অনেক রাতে ওনার ঘরে গিয়ে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তনের ক্যাসেট-টা চালিয়ে চুপ করে বসেছিল।শ্রাদ্ধের দিন যখন সবাই ব্যস্ত পুজোর কাজে, ঠাম্মীর ঘরে গিয়ে ওনার বালিশে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল আর বাঁশিটা ছবির পাশে রেখে এসেছিল।সেদিন দুপুরেও পোস্টম্যান ঘন্টি বাজিয়ে চলে গিয়েছিল ওদের বাড়ি পেরিয়ে।

কালীপুজোয় সারা পাড়ায় আলোর রোশনাই,ছোটকা নিজে তুবড়ি বানায়। প্রতি বছর নিয়ম করে রোজ সেগুলো রোদে দেওয়া হয় এক মাস ধরে।এবার বাড়ি অন্ধকার;প্রদীপ জ্বলেনি,বাজি আসেনি।
অহর্ষি ছাদে গিয়ে দেখল আকাশে ফানুস উড়ছে, আলোর মালা গুলো ঠিকরে পড়ছে হাজার হাজার তারার মত। অন্যান্যবার শব্দবাজির তাণ্ডবে ঠাম্মীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হত;বেচারি কানে তুলো গুঁজে বসে থাকতেন সন্ধ্যে থেকে।এবার সেই অবকাশ নেই।পাড়ার কুকুরগুলো মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। সপ্তর্ষিবাবু চোঙাওলা গ্রামোফোনে পান্নালাল ভট্টাচার্যের গলায় 'সদানন্দময়ী কালী' শুনছেন চোখ বুজে।সারা বাড়ি জুড়ে এক অপার নৈঃশব্দ্য।

ঠাম্মীর প্রয়ানের সাথে অহর্ষির নিঃসঙ্গতা বাড়তে থাকল;একটা শামুকের মত নিজেকে খোলসের ভেতর ক্রমশ গোটাতে থাকল সে। স্কুলে যেতে চায় না,ঘর বন্ধ করে চুপচাপ বাঁশি বাজায়।মা ভাবলেন ছেলেকে কোথাও ঘোরাতে নিয়ে গেলে বুঝি মন ঠিক হবে! 

'চলো কিছুদিন তোমার এই কোর্ট মক্কেল ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে বেড়িয়ে আসো কোথাও।মা যাওয়ার পর থেকে দিনদিন ঋষি মনমরা হয়ে যাচ্ছে,আমার যে কিছুই ভাল লাগছে না। ওমন হাসিখুশি ছেলেটা... '

'আঃ কেঁদো না। দেখছি কি করা যায়। শুনছি দেশের অবস্থা ভাল নয়। ভাব গতিক দেখে যেতে হবে।'

হেমন্তর হিমেল আবহাওয়া কাটতেই ডিসেম্বর মাস...হাল্কা শীতের আমেজ শহরে।বড়দিনের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা সবে বসতে শুরু করেছে: ফ্রুট কেক,ক্রিসমাস ট্রি,তারার মালা চারদিকে। সপ্তর্ষিবাবু ঠিক করলেন অজন্তা-ইলোরা যাবেন ছেলের মন ভোলাতে। ওখান থেকে ফিরতি পথে পুণেতে ছোটবোনের বাড়ি হয়ে কলকাতা ফিরবেন। ট্রেনের টিকিট কাটা হল। ডিসেম্বরের আট তারিখ ওরা রওনা দেবে কলকাতা থেকে বোম্বে মেইলে।ছোটকাও ওদের সাথে যাবে এবার।সমস্ত গোছগাছ চলছে এদিকে,অহর্ষির মা বাড়িতে থাকা কিছু গয়নাগাটি ব্যাঙ্কের লকারে রেখে এসেছেন;এতদিন বাড়ি তালাবন্ধ থাকবে।ওর অঙ্কের মাস্টারমশাইকেও বলা হয়েছে দু'সপ্তাহ ছুটি।যাবার তিনদিন আগে সে অপেক্ষা করল ডাকহরকরার--পাছে এর মধ্যে চিঠি এসে ফিরে যায়! পোস্টম্যান এল না,অহর্ষি রাতে ডাকবাক্সের তালাটা খুলে রাখল। 

ছয় তারিখ সন্ধ্যা থেকে দেশ শহর উত্তাল;জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বলছে,মুসলমানরা মিছিল বের করেছে,অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের খবর এসেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে সেখানে নাকি রামমন্দির নির্মাণ হয়েছিল।দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেছে,এবার রক্তের বন্যা বইবে। অহর্ষিদের পাড়া স্তব্ধ! এক দল লোক মিছিল করতে করতে মশাল নিয়ে মসজিদের ওখানে গিয়ে জড়ো হয়েছে। মাইক নিয়ে চিৎকার করে হিন্দুদের বিষোদ্গার করছে ।অহর্ষি জানলার ধারে বসে এসব শুনছিল।ওর মা অবিন্যস্ত ঘরে ঢুকে বললেন,

'তুই এখানে কি করছিস ঋষি? শিগগির চল। সব জানলা বন্ধ কর।' 

'ওরা চিৎকার করছে কেন?'

'জানিনা। দাঙ্গা লেগেছে। হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। তুই বাবার কাছে যা'

'তবে যে রবীন্দ্রনাথের 'মুসলমানীর গল্পে' কমলাকে মধুমোল্লার ডাকাতের হাত থেকে হবির খাঁ উদ্ধার করেছিলেন! উনিও তো মুসলিম ছিলেন।'

মা কোনো উত্তর করলেন না।

'আমরা আর তসলীমদের বাড়িতে ঈদের দাওয়াত খেতে যাব না?'

বলেই মাকে জড়িয়ে ধরল অহর্ষি।

অনেক রাত অবধি বোমাবাজি চলল,সেই সন্ধ্যায় কোন হিন্দু বাড়িতে শঙ্খ বাজলনা। মুসলমান মৌলবাদিরা মাঝরাতে কয়েকটা হিন্দু বাড়ি ভাঙচুর করল;পুলিশের গাড়ির সাইরেন আর বোমাবাজির আওয়াজে সবাই ঘরের দরজা এঁটে সিঁটিয়ে রইল।
রাতে অহর্ষির কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল,সারা রাত ও মাকে আঁকড়ে ধরে রইল।ভোরবেলা ওর বাবা যখন সদর দরজা খুললেন, দেওয়ালে চাপ চাপ রক্ত...গলিতে কাঁচের টুকরো,ওদের ফিয়েট গাড়িটা দুমড়ানো,আর অর্ধেক পুড়ে যাওয়া কাঠের ডাকবাক্সটা রাস্তার এক কোনে পড়ে আছে।
জানা গেল অহর্ষির সেই ঘন্টি বাজানো পোস্টম্যান কাকুকে গত রাতে দুষ্কৃতীরা খুন করে ফেলে গেছে সত্যনারায়ণ মন্দিরের ধারে...
সেদিন ভোরে মসজিদ থেকে আজানের মন কেমন করা সুর ভেসে আসছিল।

-কৌস্তভ 

------------

ছবিঋণ: বেঙ্গল ওয়েব সলিউশান 

#KaustavJoyGoswami 
#LetterBox
#ShortStory
#ছোটগল্প 
#কৌস্তভ

About Me

My photo
me?? well,to put it in a single sentence, 'Kaustav is a curious blend of Hamlet's procrastination,Lear's narcissism,Othello's fidelity,Macbeth's will power,tempered with a tinge of Antonio's vulnerability'