শিল্পী রামকিঙ্করের জীবন অবলম্বনে 'দেখি নাই ফিরে' যখন ধারাবাহিক ভাবে 'দেশ'পত্রিকায় প্রকাশিত হত আমি গোগ্রাসে পড়ার চেষ্টা করতাম:ওই কিশোর বয়সে সবটা যে বুঝতাম তা নয়,কিন্তু এটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম কোন মাত্রায় একজন সৃষ্টিকর্তা আরেকজন অগ্রজ শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারেন; এমন একাগ্রচিত্তে তাঁর শিল্প,জীবন নিয়ে গভীর গবেষণা করে এরকম একটি পূর্ণাঙ্গ,নিটোল জীবনীমূলক উপন্যাস লিখে ফেলতে পারেন! এ তাবৎকালে শান্তিনিকেতনকে এমন কাছ থেকে আর কখনো কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই উপন্যাস অর্ধসমাপ্ত রেখেই লেখক প্রয়াত হন কিন্তু একটা নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেলেন আমার মত সাধারণ পাঠকের মনে...সমরেশ বসুর যেকটি লেখা(অমৃতকুম্ভের সন্ধানে,বি টি রোডের ধারে,কোথায় পাব তারে)পরবর্তীকালে পড়ার সুযোগ ঘটেছে বারবার মনে হয়েছে একজন নিরাসক্ত বাউলের গান শুনছি!
'অনেক পড়শি তো আছে,সময় বুঝে একবার নিজের ভেতরে যে পড়শির বসত,তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের ইচ্ছা।তারা তোমায় অনেক বলেছে,তুমি তাদের অনেক বলেছ।এবার নিজেকে নিজে একটু বলা কওয়া হোক....মন,চলো যাই খোপ ছেড়ে।দেহ থাকুক পড়ে।'
'কোথায় পাবো তারে' পড়তে পড়তে আমিও সঙ্গী হয়েছি ভ্রমণের নেশায় মাতোয়ারা সেই পথিক পরাণের যে ইছামতীর বুকে ডিঙি নৌকায় ভাসতে ভাসতে এক অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করছে: সেই ছোট্ট হিন্দু ছেলেটি জলের ফোঁড় কেটে কেটে সাঁতার দিয়ে নদী পারাপার করছে আর অধর মাঝি,গাজি,নানী,সলিমা,কুসুম,চাচা,তাম্বুলরঞ্জিত চাচি,ঝিনিদের সাথে লেখক মিশে গিয়েছেন বর্ণিল মানুষের মেলায়। প্রকৃতি আর মানুষের নিবিড় সম্পর্কের এক সূক্ষ্ণ নক্সীকাঁথা বুনেছেন কালকূট তাঁর রূপক-অলংকারের অনবদ্য বিন্যাসে:বুড়িগঙ্গার ওপারে ইটভাটার চিমনি থেকে ওঠা ধোঁয়া,পাড়ের আড়ালে সবুজ পাংশু ধানক্ষেতে ডুবে যাওয়া উড়ন্ত প্রজাপতি,বনচড়াইয়ের দল,আকাশের ছায়াপড়া নীল ইছামতীর আরশি,গাঙশালিক-সমস্ত উপাদানগুলি কথকের সাথে এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র স্থাপন করে। মুরশেদের নাম করে গাজির বাঁ হাতের আঙ্গুলে প্যাচানো ঘুঙুর আর ডুবকির তালে তালে আমিও কন্ঠ মিলিয়ে গেয়েছি,
'যার তরেতে মন ভুলেছে
আমারে বলবে কে সে কোথা আছে!
তারে না দেখে যে হিয়া ফাটে
সদা মন তাপে জ্বলে যাই,
মনের মানুষ কোথা পাই....'
'পারানি','মাধুকরী' এই শব্দগুলি আমি এই উপন্যাসেই প্রথম জেনেছি...একটা অপার রহস্যময় জগতের হদিশ পেয়েছিলাম পড়তে পড়তে,ঘোর লেগে যাওয়ার মত! পথিক রবীন্দ্রনাথ যেমন চলার নেশায় বুঁদ হয়ে পাগলপারা নদীর মত বয়ে চলেছেন আজীবন,সমরেশ বসুও একইভাবে গন্তব্যহীন হয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন রূপ থেকে অরূপের এই অন্বেষণে...এক মহাকালের যাত্রায়!
- কৌস্তভ
#KothayPaboTaare
#Kalkut
#ALookingBack
#KaustavJoyGoswami
No comments:
Post a Comment