ফিরে দেখা বই | পাতা ঝরার মরশুমে
আমাদের মত bibliophile-দের অনেক সময় বহুদিন আগে পড়া কোন বই আবার নতুন করে পড়তে ইচ্ছে হয়:এর একটি সদর্থক দিক এই ,যে তখনকার পাঠে যেসব আপাত কম গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হাওয়ায় ভেসে গিয়েছিল সেগুলোকে আরেকবার নতুন করে আবিষ্কার করা যায়; এতদিনের ধুলোর আস্তরনে ছোট ছোট চিত্রগুলোর ফিকে হয়ে যাওয়া রঙগুলো আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই হঠাৎ পাওয়া অখণ্ড অবসরে তেমন কিছু বই পড়ে ফেলার সুযোগ হচ্ছে,যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের 'জীবনস্মৃতি' বা 'সঙ্গীতচিন্তা'র মত গভীর দর্শনসমৃদ্ধ বই যেমন আছে আবার ততটা ভারী নয়,এমন বই-ও আছে যা হয়ত আমার প্রাত্যহিক আটপৌরে জীবনের সাথে অনায়াসে সম্পর্ক স্থাপন করে কিন্তু খুব স্থায়ী রেশ রেখে যায় না....আসলে প্রতিটি মানুষই তো multilayered,অনেকগুলো সত্তা নিয়েই আমরা বাঁচি। আজ যে উপন্যাসটির কথা বলব সেটা আমি পড়েছিলাম ২০০৯ তে,কিন্তু তখন সত্যি, নথিভুক্ত করে রাখার মত কোনো বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করতে পারেনি,হয়তবা আমিই ততটা মনোসংযোগ করতে পারিনি। কিন্তু এই লেখকের একটা ক্রমশ বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা আমায় কিছুটা বাধ্য করেছিল বেশ কয়েকটি ছোট গল্প ও একটি উপন্যাস পড়ে ফেলতে....এই প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। উনি quintessentially এই প্রজন্মের লেখক,ওনার ভাষা নাগরিক জীবনের কথ্য ভাষা,যেখানে অনায়াসেই খিস্তি ঢুকে পড়ছে,খুব চেনা কিছু শহুরে jargon আসছে এবং সর্বোপরি এখনকার যুবসমাজের অস্থিরতা,তাদের অসহিষ্ণু দিকশূন্যহীনতা, সাধ আর সাধ্যের ব্যবধানের ফলে তৈরি হওয়া এক চূড়ান্ত প্রতিশোধস্পৃহার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। 'ঊনিশ কুড়ি' ম্যাগাজিন ওল্টাতে ওল্টাতে 'আমাদের এই শহরে' ধারাবাহিক গল্পটি পড়েছিলাম...বহু বছর আগে দূরদর্শনে দেখানো হত একটি ধারাবাহিক,'Neenv',কৈশোরের টানাপোড়েন নিয়ে,হস্টেল জীবনের বর্ণময়তা সেখানে প্রধান উপজীব্য ছিল ; তার সাথে খুব মিল পেয়েছিলাম।তারপর 'পাল্টা হাওয়া' যখন পড়েছি তার প্রেক্ষাপট,চরিত্র,তাদের রসায়নগুলো খুব চেনা লেগেছিল।রীপ,তিথি,পুষ্পল-দের সাথে আমিও সহমর্মী হয়েছি ওদের ব্যর্থতার, দেখেছিওদের প্রত্যেকের জীবনের পাল্টে যাওয়া গতিপথ। এই লেখককে পরপর যে পড়েছে তার হয়ত স্মরণজিৎ-এর কিছু imagery,শব্দের ব্যবহার,বাক্য গঠনের বুনোট পুনরাবৃত্তি মনে হবে: বাটানগর, ছোট হয়ে আসা গঙ্গা,জেটি,ওপারের ইটভাটার চিমনির ধোঁয়া,অশ্বত্থগাছ ইত্যাদি।কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে এত বছর পর আবার 'পাতা ঝরার মরশুমে' পড়ে মনে হল কিছু জায়গায় উনি খুব মৌলিক। একটা প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা-য় match fixing নিয়ে শুরু হয় উপন্যাসের আখ্যান এবং পরবর্তীকালে দিয়েগো,কবীর,ডুডু,রুদ্র,রুপাই,টাপুর-রা প্রবেশ করে গল্পে।বন্ধুত্ব, প্রণয়,প্রতিহিংসা,ও পারিবারিক সম্পর্কের চক্রব্যৃহর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এই চরিত্রগুলো কখনো philosophize-ও করে; একদিকে শীতকালের হাড় হিম করা কাঠিন্য ও পাশাপাশি তার কোমল,vulnerable রূপটি খুব স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাতন্ত্র্য মুন্সিয়ানায় এক প্রার্থিত প্রাকৃতিক আবহ রচনা করে গল্পে। এগারো বছর পর 'পাতা ঝরার মরশুমে' পড়তে পড়তে মনে হল ডিসেম্বরের কোন এক গোধূলিতে খুব দ্রুতগতিতে একটি ট্রেন নিষ্পলকে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল কিছু চেনা-আধোচনা যাত্রী নিয়ে...তারা অনেকেই হয়ত আবছাই থেকে গেছেন জীবনে।
"ঠান্ডাটা এবার সত্যিই বড় বেশি পড়েছে। ডুডু সাইকেল চালাতে চালাতেই এক হাতে জ্যাকেটের চেন গলা অবধি টেনে দিল।টমাস বাটা অ্যভিনিউয়ের ধারে ধারে যে গুলমোহর গাছ সেগুলো প্রায় সব পাতা ঝরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ও দেখল এখনো হালকা হাওয়ায় ছোট ছোট সবুজ পাতারা রঙিন কাগজের মত নেমে আসছে মাটিতে।পাতা ঝরার মরশুম এখন...পাতিলেবু রঙের একটা রোদ যাই যাই করছে আকাশে..."
#ThrowbackBooks
#PataJhawrarMorshumey
#SmaranjitChakraorty
প্রকাশক: আনন্দ
No comments:
Post a Comment