Thursday, August 27, 2020

দিনগুলি মোর || কচুরিপানা



ছোটবেলার রোব্বারগুলো ছিল অনাবিল আনন্দের। ভোরবেলা বাবার স্কুটারে চেপে পৌঁছে যেতাম কাছারিঘাট। ব্ৰহ্মপুত্ৰর পারে অবস্থিত এই জায়গাতেই সাপ্তাহিক হাট বসত।হরেক রকমের মাছ ও টাটকা সবজির পসরা নিয়ে বসত অহমিয়া বিক্রেতারা।বাবা যখন বোয়াল মাছ কিনতে ব্যস্ত আমি তখন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতাম প্রকাণ্ড নদের দিকে।মনে হত সুদূর থেকে ভেসে আসছে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠের বিখ্যাত অহমিয়া গান:
"মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র মহামিলনর তীর্থ
শত যুগ ধরি আহিসে প্রকাহি সমন্বয়র অর্থ"
এই নদের ঠিক মধ্যবর্তী অনচলে ছিল উমানন্দ দ্বীপ।বেশ একটা গা ছমছমে রহস্য ঘিরে থাকত জায়গাটিতে।ভোরবেলা সব ধার্মিক মানুষেরা মহেশ্বর কে আরাধনা করে ফিরতেন এবং নৌকাগুলি দুলুনি খেয়ে খেয়ে ঘাটের দিকে চলে আসত।সেই থেকেই নৌকা এবং মাঝি আমার মনের মণিকোঠায় একটা স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল।উত্তর পূর্বাঞ্চলের বর্ষাকালের দুটি বিপরীত রূপ।নয়নাভিরাম এবং ভয়ার্ত ।আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল 'বাণীকান্ত বালিকা বিদ্যালয়',আর তার ঠিক লাগোয়া একটা বিশাল কচুরিপানা ।বৃষ্টি হলে ভারী সুন্দর দেখতে লাগত সেই বিস্তৃত সবুজ কচুরিপানা ।পাতাগুলো থেকে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ত আর আমি সেই দৃশ্য বন্দী করতাম আমার আঁকার খাতায়।কচুরিপানায় একরকম হাল্কা বেগুনীরঙা ফুল হত।একবার হল কি,সেই বেগুনী ফুলের হাতছানি সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়লাম সেই ডোবায়।আমি তো ভয়ে চিৎকার করছি আর অদূরে দাঁড়িয়ে দরোয়ানের বাচ্চা মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে।খুব লজ্জা লেগেছিল । পরে অবশ্য সেই আমায় হাত বাড়িয়ে পানাপুকুর থেকে উদ্ধার করেছিল।এখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথের 'সমাপ্তি' গল্পের সেই দৃশ্য । অপূর্ব পাঁকে পড়ে যাওয়ার পরে মৃন্ময়ী ও ঠিক এভাবেই হেসেছিল।
বর্ষায় ফিরে আসি।কখনো দুদিনের টানা বৃষ্টিতে সারা গুয়াহাটি শহর জলমগ্ন।স্কুল কলেজ অফিস সব বন্ধ।সবাই গৃহবন্দী ।ওপরতলার মাসিমণি আর মা মিলে খিচুড়ি রান্না করত।সাথে পাঁপড়ভাজা।আমরা একান্নবর্তী পরিবারের মত একসাথেই খেতাম।বর্ষামুখর রাতগুলো কাটত বাবার কাছে গল্প শুনে।সবটাই তাৎক্ষণিক ও উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ।অনেকটা এরকম ।
"তারপর মাঝি খুব কষ্ট করে নদীতে বৈঠা বেয়ে যেতে লাগল।আর শরীর দিচ্ছে না।বাইরে নিশ্ছিদ্র অনধকার।ভীষণ মেঘ ডাকছে, বিদুৎ ঝিলিক দিচ্ছে ।মাঝির ছোট্ট ছেলেটা দেখল জালে একটা ইলিশ মাছ ধরা পড়েছে।তারপর মাঝি সেই মাছটাকে কেটে কড়াইতে ভাজা করল। ওরা দুজনে গরম ভাত দিয়ে ইলিশমাছ ভাজা খেল।"
আমার জানিনা কেন এই মাঝির জন্য খুব কষ্ট হত।মনে হত আমরা এই দুর্যোগের রাতে বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ে আছি অথচ মাঝি কত কষ্ট করছে জীবিকা নির্বাহের জন্য ।
এখন ভাবি ছেলেবেলার গল্পের এই মাঝি-ই বুঝি বড়বেলায় গান হয়ে ফিরে এসেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দর্শনে।
"ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি
শুনতে কি পাস্ ,দূরের থেকে 
পারের বাঁশি উঠছে বাজি।।"
(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
me?? well,to put it in a single sentence, 'Kaustav is a curious blend of Hamlet's procrastination,Lear's narcissism,Othello's fidelity,Macbeth's will power,tempered with a tinge of Antonio's vulnerability'